দেখতে অনেকটাই মুরগির মতো। শুধু আকারে খানিকটা ছোট। লেজটা অধিকাংশ সময় খাড়া থাকে। হাঁটার সময় লেজটাকে নাচিয়ে হাঁটে। জলাধারে কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে এলাকায় বেশি দেখা যায়। খাবারের খোঁজে অনেক সময় মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। তবে ধরার আগেই ফুরুৎ করে দৌড়ে পালায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখিদের চেয়ে বাচ্চারা বেশি হুঁশিয়ারি। সহজে ধরা যায় না ওদের। বিশেষ করে জলাশয়ে বিচরণরত কালে বাচ্চাদের ধরা কঠিন থেকে কঠিনতর কাজ। চতুর এ পাখি চেনেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই আছেন আমাদের দেশে। এমন পরিচিতি লাভের আরেকটি কারণও আছে। সেটি হচ্চে এদের নিয়ে বেশ কিছু কবিতা রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। যেমন : কবি জীবনানন্দ দাশ রচনা করেছেন ‘ডাহুকী’ কবিতা। অপরদিকে কবি র্ফরুখ আহমেদ রচনা করেছেন ‘ডাহুক’ কবিতটি। বলা যায় বাংলা সাহিত্যে এ পাখির বেশ কদর রয়েছে।
আমি শৈশবেই এদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি নিজ গ্রামে। ঘরের লাগোয়া ঝোপের ভেতর থেকে ‘কোয়াক-কোয়াক’ সুরে ডেকে কান ঝালাপালা করে দিত আমাদের। অতিষ্ট হয়ে ওদের লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ে তাড়াতে চেষ্টা করতেন বড়রা। ওরা ভয় পেয়ে উড়ে গিয়ে ঝোপ-জঙ্গলে বসে আবার শুরু করে দিত ম্যারাথন ডাক। একটানা দীর্ঘক্ষণ ডাকতে পারে এ পাখি। রাত-বিরাতেও ডাকে। বিশেষ করে সূর্যাস্তের পর বিরতিহীন ডাকতে থাকে। এ নিয়ে গ্রাম-বাংলার মানুষের ভেতরে কিছু কৌতূহল রয়েছে। নানা মানুষ নানা মন্তব্য করেন। কেউ কেউ বলেন, ‘ডাকতে ডাকতে ওদের গলা থেকে রক্তের ফোঁটা বের হয়। আর সে রক্তের ফোঁটা ওদের ডিমের ওপর পড়লেই তবে ডিম ফোটে। আবার কেউ বলেন, ‘মানুষকে ওরা বিপদ সংকেত জানায়’। আসলে ওসবের কিছুই নয়। শুধু ওদের প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে প্রেমিক পাখিটি এমন আর্তনাদ করে প্রিয়াকে মজাতে চেষ্টা করে। এরা ভালো পোষ মানে। গ্রামের শিকারিরা পোষাপাখি দিয়ে এ প্রজাতির বুনোপাখি শিকার করে। এদের মাংসে কিছুটা মুরগির মাংসের স্বাদ পাওয়া যায় বিধায় শিকারিরা এ পাখি শিকারে বেশ সচেষ্ট। অধিকধৃত হওয়ার পরও এরা আমাদের দেশে মোটামুটি সুলভ। দেখা মেলে যত্রতত্র।
এ পাখির বাংলা নামঃ ডাহুক, ইংরেজি নামঃ হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন, (White-breasted Waterhen), বৈজ্ঞানিক নামঃ আমাররনিস ফোনিকুরাস,(Amaurornis Phoenicurus), গোত্রের নামঃ রাল্লাদি ।
লম্বায় ৩২-৩৩ সেন্টিমিটার। শক্ত মজবুত গড়নের ঠোঁটের বর্ণ সবুজ। ঠোঁটের গোড়া লাল। কপাল, গলা, বুক সাদা। লেজের তলা সিঁদুরে-বাদামি। শরীরের বাদবাকি পালক ছাই-কালো রঙের। পা লম্বা লিকলিকে। পায়ের আঙ্গুলের বর্ণ সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম।
প্রধান খাবারঃ জলজ পোকামাকড়, ছোট মাছ, জলজ উদ্ভিদের কচি ডগা, ধান ইত্যাদি। পোষা ডাহুক চাল, ভাত খায়। প্রজনন সময় আষাঢ় থেকে শ্রাবণ। বাসা বাঁধে জলার ধারে ঝোপ-জঙ্গলে কিংবা জলদামের ওপর অথবা বাঁশঝাড়ে। ডিম পাড়ে ৫-৭টি। স্ত্রী-পুরুষ মিলে ডিম তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন।
লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।