বউ কথা কও | Indian cuckoo | Cuculus micropterus

2456
Indian-cuckoo
বউ কথা কও | ছবি: ইবার্ড

আমাদের দেশে রাতজাগা পাখির বাস খুব একটা নেই। উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে রয়েছে লার্জ-টেইলড নাইটজার (রাতচরা), বিভিন্ন প্রজাতির পেঁচা, নিশিবক, বউ কথা কও ইত্যাদি। দেখা গেছে, এসব প্রজাতির পাখি স্বস্থানে বসেই রাত-বিরাতে বিলাপ করে। একমাত্র ব্যতিক্রম ‘বউ কথা কও’ পাখি। এ পাখিরা উড়তে উড়তেই ডাকাডাকি করে। দিনে যেমনি ডাকে তেমনি রাতেও। চাঁদনি রাত এদের প্রিয়। আকাশে চাঁদের ঝিলিক দেখলেই এরা ‘বউ কথা কও, হক কথা কও’ বা ‘টুটু…টুটু’ সুরে ডাকাডাকি করে (শব্দটি যার কানে যেমন বাজে) এবং একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে উড়ে বেড়ায়।” তথ্যটি জানিয়েছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক।বউ কথা কও পাখির সুরের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে প্রায় তিন যুগ আগেই। তবে তখন ওদের গগনবিদারী আর্তচিৎকারটাই শুধু শুনেছি, কিন্তু দেখিনি। আকাশে উড়ে উড়ে বিলাপ করতে শুনেছি। ওই অবস্থায় দেখেছিও বহুবার। উড়ন্ত অবস্থায় মালুম করতে পারিনি ওদের বর্ণবৈচিত্র্য। কাছাকাছি থেকে দেখেছি অনেক দিন আগে। রায়পুরের (লক্ষ্মীপুর) ‘পূর্ব চরপাতা’ নামক স্থানে। বৈশাখের শেষ বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে জারুলশাখায় ওর সাক্ষাৎ পাই। খানিকটা উঁচুতে বসেছিল। কাজেই আশ্রয় নিতে হয় বাইনোকুলারের। পাখিটা ওপরের দিকে মাথাটা খাড়া করে রেখেছিল। পাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টাও করেছে। সে সুবাদে নিচ থেকে উঁকি মেরে ওকে দেখে নিয়েছি। আসলে এ পাখিদের স্বচক্ষে দেখা অনেকটাই কঠিন ব্যাপার।

যদিও এরা গ্রীষ্মকালে সচরাচর গ্রামগঞ্জে বিচরণ করে; তথাপি দেখা মেলে না। শুধু কানে সুর ভেসে আসে। কারণ এরা বেশ সুচতুর ও লাজুক। আত্মরক্ষাকে প্রাধান্য দেয়। আড়াল-আবডালে নিজেকে সবসময় লুকিয়ে রাখে। ভূমি থেকে অনেকখানি ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে ওড়াউড়ি করে। ফলে সর্বসাধারণের নজরে খুব একটা পড়ে না। গ্রামগঞ্জে বউ কথা কও পাখি নিয়ে অনেক মিথ আছে। এর সঙ্গে বাঙালির একটা আবেগও জড়িয়ে আছে। আমাদের সাহিত্যে পাকাপোক্ত আসন করে নিয়েছে বউ কথা কও পাখি। অনেক গান, কবিতা রচিত হয়েছে এদের নিয়ে। বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন বউ কথা কও পাখি নিয়ে। এদের নিয়ে যে মিথটি বেশি প্রচলিত তা হচ্ছে, ‘শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার এক পর্যায়ে শাশুড়ি ক্ষিপ্ত হয়ে বউকে অভিশাপ দিলে সে পাখি হয়ে যায়। স্বামীর প্রতীক্ষায় একটা গাছের ডালে বসে থাকে পাখিটি। স্বামী বেচারি দূরদেশ থেকে এসে মায়ের কাছে জানতে চায় তার আদুরে বউটি কোথায়? মা আঙুল তুলে গাছের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে তোর বউ’। বউয়ের উদ্দেশে ছেলে প্রশ্ন ছুড়ে, ‘বউ তুমি পাখি হয়ে গাছে বসে রয়েছ কেন?’ বউ জবাব দেয় না। কারণ সে মানুষের কথা বুঝতে সক্ষম নয়। বাধ্য হয়ে স্বামী বেচারি সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি পেশ করল, ‘আমাকে পাখি বানিয়ে দাও। আমি যেন বউয়ের ভাষা বুঝতে পারি’। সৃষ্টিকর্তা আবেদনে সাড়া দিয়ে তাকে পাখি বানিয়ে দেন। আর সে উড়ে উড়ে বউয়ের উদ্দেশে ডাকতে লাগল ‘বউ কথা কও … বউ কথা কও’।

পাখিটির ইংরেজি নামঃ ইন্ডিয়ান কুক্কু, (Indian cuckoo) বৈজ্ঞানিক নামঃ কুকুলাস মাইকোপটেরাস, (Cuculus micropterus) গোত্রঃ কুকুলিদি।

লম্বায় এরা এক ফুটের চেয়ে সামান্য বেশি। শরীরের উপরাংশ গাঢ় ধূসরের সঙ্গে পাটকিলে আভার সংমিশ্রণ। নিম্নাংশ মলিন ধূসর এবং সাদাটে মিশ্রণ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় একই রকম। পার্থক্য সামান্য। স্ত্রী পাখির ডানা মলিন ধূসর, বুক পাটকিলের ওপর লালচে আভা। চোখের মণি উভয়েরই পাটকিলে। গোল চোখের পাতা কমলা হলদেটে। ঠোঁট পাটকিলে। চিবুক, পা, আঙুল হলদেটে। বউ কথা কও পাখি শীতকালে দেখা যায় না। গ্রীষ্মে এদের আগমন ঘটে।

প্রধান খাবারঃ পোকামাকড়। গাছের ওপর বসেই এরা পোকামাকড় শিকার করে। পারতপক্ষে জমিনে এরা খুব একটা নামে না। এদের যৌনজীবন সুখকর নয়। স্থায়ীভাবে সাংসারিকও নয়। ব্যভিচারী যৌনজীবনে অভ্যস্ত। কোকিলের মতো বউ কথা কও বাসা বাঁধতে জানে না। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এরা অন্য পাখিদের বাসায় চুরি করে ডিম পেড়ে পালিয়ে যায়। বাচ্চা লালন-পালন করে অন্য পাখিরাই। বউ কথা কও পাখিদের সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি তথ্য জানা যায়নি।

লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।