বগুড়ার দই : আড়াই শ বছরের ধরে রাখা ঐতিহ্য

602
বগুড়ার দই
বগুড়ার দই | ছবিঃ ইন্টারনেট

দই আর বগুড়া যেনো সমার্থক শব্দ। কেউ কেউ বলে দইয়ের রাজধানী। আবার অনেকেই বগুড়ার নাম শুনলেই বলে উঠে বগুড়ার দই । মিষ্টি তো মিষ্টিই, তবু তার সঙ্গে দই-এর মিলন না হলে জুড়িটা যেন ঠিকমতো মেলে না। সে কারণেই লোকে বলে ‘দই-মিষ্টি’। প্রায় আড়াইশো বছরের ইতিহাস এই বগুড়ার দইয়ের। সারা বাংলাদেশে দই তৈরি হলেও বগুড়ার দই বিখ্যাত। শুধু কি বাংলাদেশ! দইয়ের প্রবল অনুরাগী ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাব মোহাম্মদ আলী। তিনি শেরপুরের ঘোষপাড়ার গৌর গোপালকে বগুড়ায় নিয়ে যান। নবাববাড়ি রোডে গৌর গোপাল তাঁর দইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৩৮ সালের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়ায় নবাববাড়িতে অতিথি হয়ে এলে নবাব তাঁকে দই দিয়ে আপ্যায়িত করেন। গভর্নর বগুড়ার দইয়ের স্বাদে পরিতৃপ্ত হয়ে ইংল্যান্ডে দই নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এভাবেই কালক্রমে বগুড়ার দই দেশের বাইরেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে

বলে রাখা ভালো দই যত জনপ্রিয়ই হোক, এটি আমাদের নিজস্ব খাদ্য নয়। প্রায় চার হাজার বছর আগে দইয়ের চল শুরু হয়েছিল সুমেরীয় যাযাবর নোম্যাডিক জাতির কল্যাণে। তারা চামড়ার মশকে করে দুধ সংরক্ষণ করত। এক বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংযোগ গাঁজন প্রক্রিয়ায় দুধ জমে দই হয়ে যেত। এখনো সেই একই প্রক্রিয়াতেই দই তৈরি হয়ে থাকে। তবে বহু পরে ১৯০৪ সালে এই ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করেছিলেন বুলগেরিয়ার বিজ্ঞানী স্টামেন গ্রিগোরভ। তাঁর স্বদেশের নাম যুক্ত করে ব্যাকটেরিয়াটির নাম রাখা হয়েছে ‘ল্যাকটোব্যাসিলাস বুলগেরিকু’। বাণিজ্যিকভাবে দইয়ের উৎপাদন এবং আধুনিক বিশ্বে দইয়ের প্রচলনের কৃতিত্ব বুলগেরিয়ার। সেই দই কালক্রমে পরিতৃপ্ত করেছে বাঙালির রসনা।

বগুড়ার দই
বগুড়ার দই | ছবিঃ ইন্টারনেট

দইয়ের আদি নিবাস যেমন বঙ্গদেশে নয়, তেমনি জিআই সনদ পাওয়া বগুড়ার দইয়ের আদি নিবাসও বগুড়া শহরে নয়, পাশের উপজেলা শেরপুরে। প্রায় দেড়শ বছর আগে শেরপুরে হিন্দু ঘোষ সম্প্রদায়ের কারিগরেরা দই তৈরির বনিয়াদ করেছিলেন। এখানে ঘোষপাড়া নামের একটি মহল্লায় গড়ে উঠেছে দই তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ। কেউ যেনো না তৈরি করতে পারে এজন্য ঘোষ পরিবার দই অতি গোপনীয়তার সাথে তৈরি করলেও গোপনীয়তা ধরে রাখতে পারেনি বেশিদিন। এখন বগুড়ার শেরপুরসহ নানা জায়গায় তৈরি হয় এই দই। তবে বগুড়ার ভেতর শেরপুর ও ধুনট এর হাসোখালী দই সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ। দই তৈরিতে ব্যবহার করা হয় দুধ, চিনি ও মাটির কাপ বা সরা। একটি বড় পাত্রে প্রায় ছয় ঘণ্টা দুধ ও চিনি জ্বাল দেওয়ার পরে যখন লালচে বর্ণ ধারণ করে তখন তা মাটির সরা বা কাপে রেখে ঢেকে রাখতে হয়। এরপর সারারাত ঢেকে রাখার পর সকালে দই প্রস্তুত হয় এবং খাওয়ার উপযোগী হয়। ১৬ মণ দুধে প্রায় ৪৫০ সরা দই বানানো সম্ভব বলে জানান দই কারিগরেরা।

বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় দই তৈরি হলেও কিছু বিশেষত্বের কারণে বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি দেশজুড়ে। উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে কারিগরদের বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণের পাশাপাশি মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তারা যত্নবান হওয়ায় বগুড়ার দই স্বাদে-গুণে তুলনাহীন