মোহনচূড়া | Eurasian hoopoe | Upupa epops

225
মোহনচূড়া
মোহনচূড়া | ছবিঃ সংগৃহীত

নিজ গ্রামে পাখিটিকে বহুবার দেখেছি, কিন্তু সঠিক নামটি জানা হয়নি তখন। জানার চেষ্টা যে করিনি, তা কিন্তু নয়। লোকজনের কাছে নামটি জানতে পেরেছি। ‘হুদ হুদ’ নামে ডাকে গ্রামের মানুষ, অনেকে আবার ‘কাঠকুড়ালি‘ও ডাকে। বিদঘুটে নাম দুটি আমার পছন্দ হয়নি। কেন জানি মনে হয়েছে, মন হরণকারী এ পাখির সুন্দর একটি নাম রয়েছে। তাই পুস্তকাদি ঘেঁটে অবশেষে এর নাম উদ্ধার করলাম। নামটি হচ্ছে ‘মোহনচূড়া’। কিন্তু এতেও স্বস্তি পাইনি।

নামের সঙ্গে পাখির শারীরিক আকৃতির মিল নেই। বিশেষ করে ‘চূড়া’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি। বাধ্য হয়ে ছুটেছি দেশের বিশিষ্ট পাখি গবেষক সাজাহান সরদার ভাইয়ের কাছে। তিনি সেদিন ছিলেন তাঁর গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলায়। সেখানে তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তুলেছেন ‘নেচার কনজারভেশন কমিটি (এনসিসি) এবং ‘বাংলাদেশ বার্ড ওয়াচার্স সোসাইটির হেড কোয়ার্টার। এখানে নির্জন পরিবেশে বসে পাখি নিয়ে গবেষণা করার প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা তিনি রেখেছেন। বলা যায়, ব্যক্তি উদ্যোগে দেশে এই প্রথম পাখি গবেষণাগার বানিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝেও কিছুটা সময় বের করে নিতে সক্ষম হলাম। আমার উদ্দেশ্য দুটি। এক তাঁর নিজের গড়া পাখি গবেষণাগারটি দেখা, দুই মোহনচূড়া পাখি সম্পর্কে টুকিটাকি তথ্য জেনে নেওয়া। বিভিন্ন ধরনের কথোপকথনের একপর্যায়ে মোহনচূড়া পাখি সম্পর্কে জানতে চাইলে সরদার ভাই হেসে প্রথমে বললেন, “পাখিটির নাম নিয়ে আমার একটু আপত্তি আছে। আসলে এটির নাম হওয়া উচিত মোহনমুকুট।

কথাসাহিত্যিক বনফুল পাখিটির নামকরণ করেছেন ‘মোহনচূড়া’। তিনি কিন্তু ওর মুকুটের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই এ নাম করেছেন। পাখির মুকুটটিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পাহাড়ের চূড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি। মুকুট কখনো চূড়া হয় না। কাজেই পাখিটির নাম ‘মোহনমুকুট’ হলে মানানসই হতো।” তাঁর সঙ্গে একমত না হয়ে পারিনি। একটা জুতসই নাম দিয়েছেন তিনি। পাখিটি দেখতে খুবই সুন্দর। রাজকীয় ভাব আছে ওর শরীরে। মুগ্ধ হয়েছি ওর গড়ন দেখে। এটি প্রথম দেখেছি আমার জন্মভূমি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার পূর্বচরপাতা গ্রামে।

বাংলা নামঃ মোহনচূড়া, ইংরেজি নামঃ ইউরোশিয়ান হুপো, (Eurasian hoopoe), বৈজ্ঞানিক নামঃ Upupa epops, গোত্রের নামঃ উপুপিদি ।

শরীরের পালক বিস্কুট রঙের, লেজ এবং ডানায় রয়েছে সাদাকালো ডোরা দাগ। ঠোঁট কালচে লম্বা, তবে সামান্য বাঁকানো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। মাথার ঝুঁটিটি রাজকীয় মুকুটের মতো দেখায়। রেগে গেলে কিংবা খোশ মেজাজে থাকলে মুকুটটি বেশ প্রসারিত করে। তখন পাখিটিকে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। অনেকটাই রাজরাজরাদের মুকুটের মতো মনে হয়। ওর মুকুটসদৃশ ঝুঁটি দেখে অনেকে এটিকে কাঠকুড়ালি বা কাঠঠোকরা বলে ভুল করে। এর ডাক বেশ মধুর। হু..পো হু..পো সুরে একনাগাড়ে ডাকতে থাকে। অনেক দূর থেকে ডাক শুনতে পাওয়া যায়। মোহনচূড়া মাঠের পাখি, গভীর ঝোপ-জঙ্গল এদের পছন্দ নয়। পারতপক্ষে এরা বনবাদাড়ে খুব একটা ঘেঁষতে চায় না। সারা দিন ঘাসভর্তি মাঠে-ময়দানে একা পড়ে থাকতে পছন্দ করে। কালেভদ্রে স্ত্রী-পুরুষ পাখিকে একত্রে দেখা যায়।

প্রধান খাবারঃ সব ধরনের পোকামাকড়ই এদের খাবার তালিকায় থাকে। লম্বা ঠোঁট গর্তে ঢুকিয়ে এরা সহজে পোকামাকড় বের করে আনে। মোহনচূড়ার প্রজননকাল মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। বাসা বানায় নির্জন স্থানের পুরনো দেয়ালে কিংবা মাটির গর্তে। ডিম পাড়ে চার-পাঁচটি। ডিমে তা দেয় শুধু স্ত্রী পাখিই। ওই সময় পুরুষ পাখি স্ত্রীর খাবারের দায়িত্ব পালন করে। প্রায় ১৮ থেকে ২০ দিন তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।

লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।