
ভাবতে অবাক লাগে নীলাম্বরি পাখির বাংলা কোনো আদি নাম নেই। আমাদের দেশের পাখি গবেষকরা মনগড়া কিছু নাম দিয়েছেন বটে, যা মোটেই জুতসই নয় এ পাখির ক্ষেত্রে। তবে বিশিষ্ট পাখি গবেষক শাজাহান সরদারের দেওয়া নামটি আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। তিনি নাম দিয়েছেন ‘নীলাম্বরী’। বলা যায়, নামটির মধ্যে একটা সাহিত্যবোধ জড়িয়ে আছে।
আমরা সবাই কমবেশি পাখিটাকে চিনি। এরা এ দেশের গ্রামাঞ্চলের পাখি হলেও মূলত এদের বাস হিমালয় অঞ্চলে। তবে ওখানে দীর্ঘ সময় কাটায় না। বেশিটা সময় কাটায় বাংলাদেশেই। সে মতে এদের আমরা দেশজ পাখি বলতে পারি নির্দ্বিধায়। নীলাম্বরী পাখি লোকজন সচরাচরই দেখে, তবে নাম জানে না অনেকেই। আমি এটিকে প্রথম দেখেছি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার পূর্ব চরপাতা গ্রামে। ওখানে সুপারিগাছের ঘন পাতার আড়ালে লক্ষ করেছি এক ভরদুপুরে।
পাখিটাকে ওই দিনই দেখেছি লম্বা সুপারি গাছের পাকা সুপারির থোকায় বসে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কী খাচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুঝতে পারি না। বুঝতে না পারার অন্যতম কারণ পাখিটার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গেলাম তাৎক্ষণিক ভাবে। ফলে অমনোযোগী হয়ে গেলাম ওর রূপের ফাঁদে পড়ে ক্ষণিকেই। শুধু আমিই নই, যে কেউই মুগ্ধ হবেন এর রূপে, তা হলফ করে বলতে পারি। পাখিটাকে যখন আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি, ঠিক তখনই বেরসিক একটা লোক এসে আমার সঙ্গে খাজুরে আলাপ জুড়ে দিলেন। ফলে খুব বেশি কিছু জানতে পারিনি। ওর জীবনবৃত্তান্ত বেশি কিছু জানতে না পারলেও রূপের ঝলকানিটা মনে গেঁথে রয়েছে ঠিকই। উল্লেখ্য, কোনো পাখিই প্রথম দেখাতে বেশি কিছু জানা সম্ভব হয় না। পাখিদের সম্পর্কে বিশদ জানতে হলে দিনের পর দিন পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন। সে সুযোগটি অন্যান্য পাখির ক্ষেত্রে পেলেও নীলাম্বরীর ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠেনি। তার পরও স্বল্প সময়ের পর্যবেক্ষণে এর শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনাটা দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
পাখিটির বাংলা নামঃ নীলাম্বরি, ইংরেজি নামঃ Verditer Flycatcher, বৈজ্ঞানিক নামঃ Eumyias Poliogenys, গোত্রের নামঃমুস্কিকাপিদি, | তার দৈর্ঘ্য মাত্র ১৬ সেন্টিমিটার। নীল-কটকটিয়া, নীল চটক নামেও উল্লেখ হয় তাদের। এরা আকারে দোয়েলের মতো।
আরও পড়ুন…
•সাদাভ্রু নীলচটক
•কালাপাশ চুটকি
•বাদামি চটক
•বাদামিবুক চটক
•সাদা কালো লাটোরা
•শিয়ালেবুক নীল চটক
•ধলাভ্রু চুটকি
•দুধরাজ
নীলাম্বরীর শরীরটা হালকা নীলচে সবুজ। পাখার অগ্রভাগটা কালচে। ঠোঁট, চোখ, পা এবং পায়ের নখ কালো বর্ণের। লেজের তলার বর্ণ হালকা সাদা। লম্বায় পাখিটি বড়জোর ছয়-সাত ইঞ্চি। নীলাম্বরীর শরীরটা হালকা নীলচে সবুজ। পাখার অগ্রভাগটা কালচে। ঠোঁট, চোখ, পা এবং পায়ের নখ কালো বর্ণের। লেজের তলার বর্ণ হালকা সাদা। লম্বায় পাখিটি বড়জোর ছয়-সাত ইঞ্চি। নীলাম্বরী চঞ্চল প্রকৃতির পাখি। বেশিক্ষণ কোথাও চুপচাপ বসে থাকার পাখি নয় ওরা। পাখিটি শুধু চঞ্চলই নয়, বলা যায় বেশ ফুর্তিবাজও। (কিছুক্ষণ পরপর ‘কি..রি কি..রি’ শব্দে চেঁচিয়ে ফুর্তি করে। রেকর্ড প্লেয়ারে আওয়াজটি বন্দি করে মনোযোগ সহকারে শুনে এ শব্দটা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি ) সারা দিন উড়ে বেড়াতে পছন্দ করে। অবশ্য এ উড়ে বেড়ানোর পেছনে একটি কারণ আছে বৈকি। কারণটি হচ্ছে ওড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওরা পতঙ্গ শিকারে মত্ত থাকে।
প্রধান খাবারঃ পতঙ্গভুক পাখি হওয়ায় বাড়ির আশপাশে কমই দেখা মেলে। (মাঝেমধ্যে ফল খেতেও দেখা যায়) স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। জোড়ায় জোড়ায় এরা কমই থাকে। শুধু প্রজননের সময় হলে ওরা জোড়া বাঁধে। এদের প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে আগস্ট। এ সময় এলে ওরা গাছের ফাঁক-ফোকরে চায়ের কাপের মতো বাসা বানিয়ে তিন-চারটি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে প্রায় বিশ দিনের মতো। এর বেশি কিছু নীলাম্বরী সম্পর্কে জানা যায়নি।
লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।