নীলকণ্ঠ | Indian roller | Coracias benghalensis

300
Indian-roller
নীলকণ্ঠ | ছবিঃ সংগৃহীত

পাখি দেখার বাতিক যৌবনে ধরেছিল, তা রয়ে গেছে আজও। মূলত পাখি শিকার থেকে পাখিপ্রেমের জন্ম। বলা যায়, অনুশোচনার বহিঃপ্রকাশ। কোথাও বেড়াতে গেলে তাই অনুসন্ধানী মন এখন ইতিউতি করে খুঁজতে থাকে পাখ-পাখালির দঙ্গল। একবার সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে। ওখানে স্বাভাবিকভাবে যেতে হয় নাফ নদী অতিক্রম করে। স্বভাবসুলভ আচরণ নিয়ে বাইনোকুলারটা চোখে ঠেসে ধরে মিয়ানমার সীমান্তের দিকে তাকাতেই যে পাখিটা গাছের ডালে বসে থেকে দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে তার নাম শুনেছি, দেখেছি বহুবার। কিন্তু চিনেছি এবারই প্রথম।

চিনিয়েছেন অখ্যাত একজন পাখিপ্রেমিক। পাখিটির নাম ‘নীলকণ্ঠ’। বাড়ির পাশে টেলিগ্রাফের তারে বসে থাকতে যে কতবার দেখেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তখন ঘূণাক্ষরেও জানা হয়নি এই সেই নীলকণ্ঠ পাখি। বাহারি রং আর রূপের ঝলকে চোখ ঝলসে গেছে বহুবার। শত্রু পাখি মনে করে এয়ারগানের গুলি ছুড়তে হাত কাঁপেনি তখন। সেটি ভেবে সত্যিই এখন অনুশোচনায় কাতর হয়ে ওঠে মন। অমন সুন্দর পাখি বধ্ করার চিন্তা কেন এল মাথায়!

পাখিটি দেখতে সত্যিই সুন্দর। দেহের তুলনায় মাথাটা একটু বড়। খুঁত বলতে এটুকুই। না হলে এর সৌন্দর্যের কাছে অন্য পাখিরা নস্যি। এদের শরীরে আছে দুই রকমের পালক। গাঢ় ও কিছুটা হালকা নীল। মাথাটা বাহারি নীল রঙের। গলা ও বুকে খয়েরি, বাদামির সংমিশ্রণ। বুকের নিচটা নীলাভ সবুজ। পিঠ পোড়ামাটি রঙের। লেজ নীল, পা ইট রঙের, আঙুল কালো। কণ্ঠে নীলের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। তার পরও ওর নাম নীলকণ্ঠ!

পাখির বাংলা নামঃ নীলকণ্ঠ, ইংরেজি নামঃ ইন্ডিয়ান রোলার (Indian roller), বৈজ্ঞানিক নামঃ Coracias benghalensis, গোত্রের নামঃ কোরাসিআইদি | ইউরোপে ‘ইউরোপিয়ান রোলার’ নামে পরিচিত। নীলকণ্ঠ লম্বায় ৩৫ থেকে ৩৭ সেন্টিমিটার।

আরও পড়ুন…
•পাহাড়ি নীলকণ্ঠ

বিশ্বের তাবৎ নীলকণ্ঠ (১৭ প্রজাতি) পাখির মধ্যে সৌন্দর্যের শীর্ষে রয়েছে ‘ইউরোপিয়ান রোলার’। এরা আকারে একটু ছোট হলেও দেখতে বেশ লাগে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নীলকণ্ঠের দেখা মেলে। বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি দেখা যায় । দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তানে এদের দেখা মেলে। বন, ঝোঁপ-ঝাড় এদের পছন্দ নয়। পতঙ্গভূক পাখি বিধায় এরা সাধারণত খোলা মাঠে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তেলাপোকা, ফড়িং, পঙ্গপালসহ বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় এদের প্রিয় খাবার। এ জন্যই হয়তো ইউরোপের কৃষকরা নীলকণ্ঠ পাখি ফসলের মাঠে বিচরণ করতে দেখলে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছেও নীলকণ্ঠ পূজনীয়। তাদের বিশ্বাস, বিজয়া দশমীর দিন মহাদেব নীলকণ্ঠ পাখির রূপ ধারণ করে ধরণীর বুকে বিচরণ করেন।

দেখতে সুন্দর হলেও নীলকণ্ঠের গানের গলা বিশ্রী। চেঁচামেচি ছাড়া ওরা আর কিছুই জানে না। স্বভাবে অনেকটাই হিংসুটে প্রকৃতির। এক এলাকায় বা মাঠে সাধারণত এক বা দুই জোড়ার বেশি নীলকণ্ঠ দেখা যায় না। অন্য দম্পতি ঢুকলে তুমুল ঝগড়া বেধে যায়। ফলে প্রতিপক্ষের কাছে হেরে ওরা পালাতে বাধ্য হয়। ভুলেও এ সীমানা আর মাড়ায় না।

নীলকণ্ঠ পাখিদের প্রজনন সময় হচ্ছে মূলত বসন্তকাল। এ ছাড়া বছরে আরেকবার ডিম পাড়ে। শুধু মাত্র ডিম পাড়ার সময় এরা জুটি বাঁধে। মিলন শেষে নীলকণ্ঠ মরা তাল, খেজুর, নারিকেল গাছের কোটরে কিংবা পাহাড়ের গায়ে ছোট গর্তে বাসা বাঁধে। সামান্য খড়কুটো দিয়েই বাসাটাকে পরিপাটি করে তোলে। কোনো কারণে যদি এরা বাসা বানাতে ব্যর্থ হয় অথবা তৈরি করা বাসা কারো দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে ক্ষেত্রে ওরা শূন্যে উড়তে উড়তে ডিম পেড়ে দেয়। তাতে অবশ্য ডিম আর ডিম থাকে না, যা হওয়ার তাই হয়। তবে এটি ঘটে কালেভদ্রে। সাধারণত বাসা তৈরি শেষ করে দুই দিন সময় নেয় এরা। তারপর স্ত্রী নীলকণ্ঠ তিন-চারটি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে মিলে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন। বাচ্চারা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি চটপটেও হয়।

লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।