
এ পাখিদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে। পদ্মার চরে দেখেছি। তখনো বুঝতে পারিনি এরা বিশেষ আকর্ষণীয় পাখি। প্রথম দেখাতে এদের পাতি হাঁস ভেবে ভুল করেছি। আসলে কিন্তু তা নয়। এরা হাঁস গোত্রের হলেও ভিন্ন প্রজাতির পাখি। এ পাখিরা ঘনঝোপ, ঘাস অথবা আগাছা বিস্তৃত জলাশয় এড়িয়ে চলে। পলিময় উপকূল অঞ্চল, হাওর, নদ-নদীতে এদের বিচরণ। এরা নিশাচর হলেও দিনের আলোতেও বিচরণ করে। বিশেষ করে ভোর-সন্ধ্যায় বেশি বিচরণ করে। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। আবার দলবদ্ধভাবেও থাকে। ডাকে উচ্চস্বরে ‘আ-আঙ্গ আ-আঙ্গ’ সুরে। ওড়ার সময় আওয়াজ করে ‘আ-আখ..আ-আখ’ সুরে।
এ পাখি শীতকালে বাংলাদেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। এশিয়ায় মূলত এদের বিস্তৃতি তুরস্ক থেকে জাপান পর্যন্ত। এছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকার উত্তর দক্ষিণাংশে এদের দেখা মেলে। এ পাখিদের বন্ধন অত্যন্ত মধুময়। কথিত আছে, কোনো কারণে যদি এদের জোড়া থেকে একটি পাখি মারা যায় অথবা শিকারিদের শিকারে পরিণত হয় তাহলে জোড়ের অন্য পাখিটি আর্তনাদ করতে করতে মারা যায়। এমনই অটুট এদের বন্ধন। আর এ বন্ধনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এদের নামকরণ হয় চখা-চখি। বর্তমানে পৃথিবীতে ওদের অবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। জানা যায়, সমগ্র পৃথিবীতে এ পাখির সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতির পাখি সংরক্ষিত হিসেবে রয়েছে।
বাংলায় পুরুষ পাখির নামঃ চখা, স্ত্রী পাখির নামঃ চখি, দুয়ে মিলে নাম হয়েছে চখা-চখি। ইংরেজি নামঃ রাড্ডি শেলডাক, (Ruddy Shelduck), বৈজ্ঞানিক নামঃ টাডোর্না ফেররুগিনি (Tadorna Ferruginea), গোত্রের নামঃ আনাটিদি ।
এরা লম্বায় ৬৭-৭০ সেন্টিমিটার। ঠোঁট ৪.৩ সেন্টিমিটার। পা ৬ সেন্টিমিটার। লেজ ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। গায়ের অধিকাংশ পালকই কমলা-বাদামি বর্ণের। মাথা, গলা সাদাটে। ডানা ধাতব-সবুজ, সাদা, কালো এবং বাদামি। ঠোঁট, পা ও লেজ কালো। স্ত্রী পাখির বর্ণ সামান্য উজ্জ্বল। দেখতে প্রায় একই রকম। তবে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় প্রজনন মৌসুমে। এ সময়ে পুরুষ পাখির গলায় কালো বলয় তৈরি হয়। স্ত্রী পাখির হয় না।
এরা সর্বভুক পাখি। জলজ পোকামাকড় থেকে শুরু করে ছোট মাছ, ছোট ব্যাঙ, ধান, ঘাসের কচি ডগা সবই খায়। প্রজনন সময় মে থেকে জুন। বাসা বাঁধে তিব্বত ও উত্তর এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে। উঁচু মালভূমি বা জলাভূমির কাছাকাছি গর্তে পালক দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৮-১০টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২৮-৩০ দিন। স্ত্রী পাখি একাই ডিমে তা দেয়। পুরুষ পাখিটি পাশে বসে থাকে তখন। শাবক উড়তে শিখে ৫৫ দিনে। বয়োপ্রাপ্ত হতে সময় লাগে প্রায় ২ বছর।
লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।