নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি আমাদের দেশীয় প্রজাতির পাখি হলেও সহজে দেখা মেলে না, শুধুমাত্র বসন্তকালে এদের দেখা মেলে। এ সময়ে শুধু গ্রামেগঞ্জেই নয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন উদ্যানে প্রবেশ করলেও গাছের শীর্ষশাখা থেকে ওদের ডাক শুনা যায়। এদের গাছে বসার ভঙ্গিটা একটু ব্যতিক্রম। খাড়া হয়ে বসে। একটানা অনেকখানি পথ এরা উড়তে পারে না। উড়ন্ত অবস্থায় ভালো মতো পরখ করলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। মনে হয় উড়তে উড়তে বুঝি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
গত বসন্তে পাখিটাকে প্রথম দেখি রিকাবী বাজারের পূর্বপাড়ায়। মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম পৌরসভায় অবস্থিত বাজারটি। খানিকটা ঘনবসতি এলাকা। দালান-কোঠার ফাঁক-ফোকরে যৎসামান্য গাছ-গাছালি রয়েছে ওখানে। সে সুবাদে কিছু পাখ-পাখালির আড্ডাজমে এতদাঞ্চলে। এ পর্যন্ত বেশ ক’প্রজাতির পাখির সাক্ষাৎ পেয়েছি রিকাবী বাজারের আশপাশে। তম্নধ্যে এ পাখিটাই বেশি আমার দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। আতাগাছের পাতার আড়ালে বসে আতাফল ঠুঁকরিয়ে খাওয়া অবস্থায় ওকে আমি আবিষ্কার করি। আমাকে দেখে ও গাছের শীর্ষ শাখায় অবস্থান নেয়। মুখের খাবার ফেলে দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টা টের পেয়ে আমিও সটকে পড়ি।
পাখিটা দেখতে যেমনি সুন্দর তেমনি গানের গলাও। তারপরও ওরা গায়ক পাখি হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করতে পারেনি। গায় করুণ সুরে। তাল-লয়-ছন্দ মেনে গান গায়। ‘পুক্র্ক… পুক্র্ক… পুক্র্ক’ শব্দে ডাকে। পরপর তিনবার ডেকে দম নিয়ে পুনরায় অস্পষ্টভাবে ‘কুক্’ শব্দ করে। এরা একটানা বেশি সময় ধরে ডাকে না। থেমে থেমে ডাকে। ওদের গান শুনে মনে হয় বুঝি ওরা চিরদুঃখী। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সুখ-দুঃখে একই ধরনের সুরে ডাকে। তবে মজাদার বিষয় হচ্ছে ওদের সুর শুনা যায় কিন্তু সহজে দেখা যায় না। পাতার আড়ালে নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখে গান গায়। গানের আওয়াজ প্রায় ৬০০-৬৫০ মিটার থেকেও শুনা যায়।
সুন্দর এ পাখির বাংলা নামঃ নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি, ইংরেজি নামঃ ব্লু-থ্রোটেড বারবেট, (Blue-throated Barbet), বৈজ্ঞানিক নামঃ Megalaima asiatica, গোত্রের নামঃ মেগালাইমিদি । আমাদের দেশে মোট তিন ধরনের বসন্তবউরি দেখা যায়। যথা: বড় বসন্তবউরি, নীলকণ্ঠ বসন্তবউরি, ছোট বসন্তবউরি।
আরো পড়ুন…
•নীলকান বসন্তবউরি
•সোনালি গলা বসন্তবউরি
•ছোট বসন্তবাউরি
•বড় বসন্তবাউরি
•বেঘবৌ
এ পাখি লম্বায় ২১-২৩ সেন্টিমিটার। এদের কপাল ও ঘাড় সিঁদুর লাল। মাথার তালু কালচে। ঘাড়ের দু’পাশে দু’টো লালফোটা। মাথার নিচ থেকে গলা পর্যন্ত নীল। বুক থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত হলদেটে সবুজ। লেজের তলার প্রান্তটা নীলচে। পিঠ ঘাস-সবুজ। ডানা বুজানো অবস্থায় সবুজ। নিচে সাদা। ঠোঁট মোটা ত্রিকোনাকৃতির। ঠোঁটের গোড়ায় অল্পক’টি খাঁড়া লোম। চোখের মনি কমলা রঙের বৃত্তদ্বারা আবৃত। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম।
সব ধরনের বসন্তবউরিদের প্রিয় খাবারই হচ্ছে ছোট ছোট ফল-ফলাদি। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুলাই। গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। পছন্দসই গাছ খুঁজতে ৩-৪দিন সময় লেগে যায়। ডিম পাড়ে ২-৩টি। ডিমের বর্ণ সাদা। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ফুটতে সময় লাগে ১৭-২২ দিন। শাবক উড়তে শেখে ২৫-২৮দিনে।
লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।