অতিসুলভ দর্শন পাখি এরা। এদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ব্যাপার-স্যাপারও। অনেক গান, কবিতাও রচিত হয়েছে এ পাখি নিয়ে। গ্রামেগঞ্জে কিংবা মফস্বল এলাকায় ব্যাপক নজরে পড়ে এখনো। দলবদ্ধভাবে বাস করে। সারাদিন চেঁচামেচি করে কাটায়। সামান্যতেই রেগে যায়। নিজেদের মধ্যে কোলাহল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পাখিটা অতি সহজে কারো দৃষ্টিতে না পড়লেও ওদের বাসাটা ঠিকই সবার নজর কাড়ে। তাল, নারকেল কিংবা খেজুর গাছে সারিবদ্ধভাবে ঝুলতে দেখা যায়। সেই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! এ পাখির বাসা বানানোর কৌশল রীতিমতো বিস্ময়কর বটে। সুনিপুণ কারিগর বলা যায় এদের।
প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে পুরুষ পাখি খেজুর, নলখাগড়া, নারিকেল অথবা তালপাতার পাশ থেকে চিকন লম্বা অংশ ঠোঁট দিয়ে কেটে নেয়। অতঃপর সেটি বয়ে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত গাছের পাতার সঙ্গে সেলাই করে জুড়ে দেয়। এভাবেই বাসা তৈরির সূত্রপাত ঘটায়। তারপর ওই বিন্দুকে কেন্দ্র করে তৈরি করে বলয়। বলয়ের চারপাশটা চিকন পাতা দিয়ে সেলাই করে চোঙ্গাকৃতির বাসা বানায়। নিজস্ব শৈল্পিকগুণে তৈরি করে দৃষ্টিনন্দন বাসা। বাসার ওপর-নিচ থাকে খানিকটা সরু আর মধ্যখানটা থাকে মোটাসোটা। বাসার মুখ থাকে নিচের দিকে। বাসা তৈরি হলে স্ত্রী পাখি ডিম পেড়ে তা দিলেও পুরুষ পাখি থাকে অন্য ধান্ধায়। পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এ পাখির বাসা এতই মনোমুগ্ধকর যে, মানুষ তাদের ড্রইংরুমে ঝুলিয়ে রাখতে গর্ববোধ করেন। ঝুলিয়ে রাখে নামিদামি আবাসিক হোটেলগুলোতেও। বলা যায় অনেকটা শোপিসে পরিণত হয়েছে এদের বাসা।
প্রিয়পাঠক, এ পাখির বাংলা নামঃ বাবুই, ইংরেজি নামঃ বায়া উইভার, (Baya weaver), বৈজ্ঞানিক নামঃ প্লসিয়াস ফিলিপপিনাস, (Ploceus philippinus), গোত্রের নামঃ পাসেরিদি । অঞ্চলভেদে ‘বাউই’ নামেও পরিচিত।
বাবুই পাখি লম্বায় ১৩-১৪ সেন্টিমিটার। প্রজনন সময় পেরিয়ে গেলে স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হয়। প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে দেহের রং বদলায়। তখন পুরুষ পাখির মাথা হলুদ আকৃতি ধারণ করে। ঘাড়ের ওপর বন্ধনী তৈরি হয়ে বুকে গিয়ে ছড়িয়ে যায়। কপাল, কান, থুতনি ও গলার বর্ণ হয় কালচে-বাদামি। অপরদিকে ওই সময় স্ত্রী পাখির ওপরের দিক হলুদাভ-বাদামি রং ধারণ করে। তার ওপর থাকে বেশ কিছু গাঢ় বাদামি রেখা। ভ্রু, ঘাড়ের পাশ এবং বুক হলুদাভ-বাদামি। নিচের দিকে হলুদের আভাযুক্ত। তবে কোনো রেখা বা ডোরা থাকে না।
বাবুই পাখির প্রধান খাদ্য শস্যবীজ। ধান, কাউন প্রিয়। প্রজনন সময় ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই। বাসা বাঁধে তাল, খেজুর, নারিকেল গাছের পাতার সঙ্গে সেলাই করে। ডিম পাড়ে ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন।
লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।