অক্টোবরের মাঝামাঝি। এক রাতে নেচার কনজারভেশন কমিটি (এনসিসি) থেকে ফোন এসেছে পদ্মার চরে যেতে। সেখানে পাখিশুমারির কাজ চলছে। আমি যেন আগামীকাল দলের সঙ্গে যোগ দিই, সে রকম আহ্বান ছিল এনসিসি থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে। কারণ পর দিন নিজ গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর যেতে হবে। মা অসুস্থ। কাজেই এখানে অন্য কোনো কথা চলছে না আর। সোজা চলে গেলাম গ্রামে। মায়ের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে বিশ্রামাদি সেরে বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখছি। বিশেষ করে ঝোপ-জঙ্গলের ফাঁকফোকরে নজর রাখছি বেশি। উদ্দেশ্য একটাই, যদি কোনো পাখ-পাখালির সন্ধান মেলে। তাহলে অন্তত পদ্মার চরে যেতে না পারার ব্যথা কিছুটা লাঘব হবে।পায়চারি করতে করতে একটা ঝোপের দিকে এগোলাম। ওটার ভেতর থেকে চিঁচি শিস ভেসে আসছে। শুনে থমকে দাঁড়ালাম। আমার পরিচিত শিস না এটি! নিশ্চয়ই আশপাশে ‘ফটিকজল’ পাখি আছে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ধারণাটা সঠিক হলো। মিনিট খানেকের মাথায় দেখলাম এক জোড়া ফটিকজল পাখি পাতার ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওরা পোকামাকড় খুঁজছে ( পোকামাকড় ওদের প্রধান খাবার)। আর সেই সূত্রে আমি ওদের বেশ কিছুটা সময় লাগিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সত্যিকথা বলতে কি, ফটিকজল পাখির রূপের ছটায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। তাই দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ ধ্যানমগ্ন হয়ে। মনে হচ্ছে কোনো শিল্পীর হাতের আকা ছবি দেখছি। ওদের এমনই আদুরে গড়ন যে, একবার দেখলে ঝট করে চোখ ফেরানো সম্ভব নয়।ফটিকজল আমাদের দেশীয় পাখি। গ্রামাঞ্চলের অনেকের কাছে ‘হলুদ টুনি’ নামে পরিচিত। দেশের প্রায় সব স্থানেই এদের দেখা মেলে। এমনকি ঢাকা শহরের পার্কেও। অনেক মিথ আছে ওদের সম্পর্কে। অনেক সাহিত্যচর্চাও হয়েছে ফটিকজল নিয়ে। গ্রীষ্মের দাবদাহে এরা নাকি ‘টিক… জল, টিক… জল’ শব্দ করে ঘুরে বেড়ায় এমনটিও শোনা যায় গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে।
এ পাখিদের ইংরেজি নামঃ কমন আয়োরা,(Common iora), বৈজ্ঞানিক নামঃ ইজিথিনা টিফিয়া (Aegithina tiphia)। এরা ইজিথিনিনি উপগোত্রের।
লম্বায় ১৩-১৪ সেন্টিমিটার। নাদুস-নুদুস গড়ন। ফটিকজল পাখির মাথা, পিঠ ও গলার নিচ থেকে পেট পর্যন্ত সবুজাভ হলুদ। ডানার দুই পাশ কালোর ওপর সাদা দাগ নিচের দিকে নেমে গেছে। ঠোঁট, পা সিসা নীল। স্ত্রী পাখি দেখতে একই রকম মনে হলেও পার্থক্য রয়েছে বিস্তর। যেমন পুরুষ পাখির ঘাড়, লেজ কালো। স্ত্রীর ঘাড় হলদেটে লাল আর লেজ হলদেটে। তবে ওদের পেটের দিকটা হলুদ ও উপরের সবুজ পালক একটু প্রকট। ডানা সবুজের ওপর পাটকিলে।
ফটিকজলদের প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে আষাঢ় পর্যন্ত। প্রজননকালে পুরুষ পাখিটা স্ত্রী পাখির পিছু ছুটোছুটি করে। মিষ্টি সুরে গান ভাঁজে তখন। স্ত্রী পাখির মন গলাতে পারলে ঘর বাঁধা হয়। মিলন শেষে মাটির কাছাকাছি ডালে পেয়ালাকৃতির বাসা বাঁধে ওরা। বাসা তৈরি হলে স্ত্রী পাখি দু-চারটি ডিম পাড়ে এবং সে নিজে একা ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। বাচ্চা ফুটতে লাগে ১৬-১৮ দিন।
লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।