লক্ষ্মীপেঁচা পাখির মুখাবয়ব অনেকটাই মানবশিশুর মতো। গোলাকৃতির মুখ, বড় বড় চোখ এবং চেপ্টা ঠোঁটটি মানুষের নাকের আদলে হওয়ায় এমনটি মনে হয়। একটা সময় এ পাখি আমাদের দেশে সুলভ দর্শন ছিল। বর্তমানে এদের বাসস্থান সংকটের কারণে অসুলভ হয়ে পড়েছে। তাছাড়া এরা কালেভদ্রে নজরে পড়লেও উৎসুক মানুষের কাছে নাজেহাল হয় খানিকটা। অবশ্য যারা এদের চেনেন, তারা মোটামুটি পাখিটাকে নিরাপদে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এরাও মানুষকে কিছুটা নিরাপদ মনে করে। তাই মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এ পাখি। গভীর জঙ্গল এদের অপছন্দ। পুরনো দোর-দালান কিংবা গাছের কোটরে এদের বাসস্থান। নিরাপদ মনে হলে একই বাসায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। থাকে জোড়ায় জোড়ায়। এরা নিশাচর হলেও খুব ভোরে এবং গোধূলি লগ্নে শিকারে বের হয়।
কখনো মানুষের কোনো ধরনের অনিষ্ট করে না এরা; বরং কিছুটা উপকারেই আসে। ইঁদুর খেয়ে মানুষের ফসল রক্ষা করে। প্রতিদানে মানুষও এদের আগলে রাখার চেষ্টা করে। এদের মাংস ভক্ষণে অরুচি থাকায় শিকারিরাও এ পাখি শিকার করে না খুব একটা। এত কিছুর পরও ওরা আজ অস্তিত্ব সংকটে। এর প্রধান কারণটি হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। খাদ্য সংকটও আরেকটি কারণ।
তার ওপর রয়েছে গাছের প্রাকৃতিক কোটর স্বল্পতা এবং পুরনো দর-দালান হ্রাস পাওয়াতে ওদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে ব্যাপকভাবে। এতে চিরচেনা এসব পাখি সাধারণ মানুষের কাছে আজকাল অচেনা হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ জেলায় অমনটি ঘটেছে। এ প্রজাতির একটি পাখি ছয়তলা ভবনে ঢুকে পড়লে ওটাকে অক্ষত অবস্থায় ধরে চিড়িয়াখানায় পাঠানোর উদ্যাগ নেয়া হয়। এ ধরনের প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায় আমাদের দেশে। এতে ওই পাখিটা নিরাপদ হতে পারলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায় ওদের পরিবারের। প্রথমত ওর জুড়ি পাখিটার আহাজারি, অবশেষে এলাকা পরিত্যাগ। দ্বিতীয়ত যদি ওই পাখির ডিম অথবা শাবক থেকে থাকে, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে, তা অনুমেয়। তাই আমাদের প্রত্যাশা, বিরল বন্যপ্রাণী অথবা যে কোনো ধরনের বন্যপ্রাণী ধরা পড়লে ওকে চিড়িয়াখানায় না পাঠিয়ে বরং চিকিৎসা দিয়ে ওর পরিবেশেই ওকে উন্মুক্ত করে দেয়া।
এ পাখির বাংলা নামঃ লক্ষ্মীপেঁচা, ইংরেজি নামঃ বার্ন আউল (Barn Owl), বৈজ্ঞানিক নামঃ Tyto alba, গোত্রের নামঃ টাইটোনিদি।
আরো পড়ুন…
•খয়রা মেছো পেঁচা
•কোটরে পেঁচা
•ডোরা কালিপেঁচা
•ছোটকান পেঁচা
•চিতিপেট হুতুমপেঁচা
•খাকি ভুতুম পেঁচা
•ভূমা পেঁচা
•খয়রা গাছপেঁচা
•উদয়ী নিমপেঁচা
•হলদেবাদামি ভূতম পেঁচা
•কালো পেঁচা
এরা লম্বায় ৩৪-৩৫ সেন্টিমিটার। এদের গোলাকৃতি মুখটি ধবধবে সাদা। ঘাড় ও ডানা হলদে-বাদামি। দেহের উপরের দিকটা সোনালি-বাদামি। গলা, পেট, বুক থেকে নিচের দিকে সামান্য চিতি। লম্বা ঠোঁটটি মাংসল সাদা। ঠোঁটের গোড়ার দিকে চেপ্টা মোমের মতো উন্মুক্ত ঝিল্লি মাংসল। চোখ গোলাকৃতির। লেজ খাটো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম।
লক্ষ্মীপেঁচার প্রধান খাবার ছোট সরীসৃপ, ইঁদুর, ব্যাঙ, ছোট পাখি ইত্যাদি। জানা যায়, খাদ্য ও বাসস্থান ঠিকঠাক থাকলে বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করতে সক্ষম লক্ষ্মীপেঁচা দম্পতি। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৩০-৩৪ দিন।
লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।