দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে, আমাদের দেশে নিশিবক এর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। তিন দশক আগেও গ্রামগঞ্জের ডোবা-পুকুর কিংবা খানাখন্দে অহরহ নিশিবকের সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। সন্ধ্যার সামান্য পরেই এরা ‘ওয়াক… ওয়াক…’ আওয়াজ করে কচুরিপানার ভেতরে ছোটাছুটি করত। আমরা তাড়াতে চেষ্টা করতাম। ওরা যেত না। কিছু সময় নীরব থেকে পুনরায় ডাকাডাকি। এখন আর গ্রামগঞ্জে সে ডাক শোনা যায় না। পাখি দেখিয়েরা ইচ্ছা করলেও সহজে এদের অবস্থান জানতে পারছেন না। কারণ এরা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
খাবার এবং বাসস্থানের অভাবে মূলত এরা এ দেশ থেকে বিদায় নিচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে শিকারিদের দৌরাত্দ্য। কদিন আগে এক বন্ধু জানিয়েছেন, তিনি নাকি নিশিবক দেখেছেন লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার ডাকাতিয়া নদীর তীরে। ছুটে যাই সেখানে। পর পর দুদিন ডাকাতিয়ার তীরে গিয়ে ভাসমান কচুরিপানার ওপরে নিশিবকের হদিস পাই। সময়টা সূর্যাস্তের কিছু পর। তখনো আধার নামেনি। নীড়ে ফেরেনি সব জলচর পাখি। মাত্র গরু-বাছুর গোয়ালে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করছেন গৃহস্থরা। ঠিক সে সময় বন্ধুকে নিয়ে ডাকাতিয়ার তীরে পৌঁছে নিশিবক দেখি। দেখতে বেশ সুন্দর পাখিটা। অন্যসব বকের চেয়ে এদের চেহারাই আলাদা।
নিশিবকের ইংরেজি নামঃ ব্লাক ক্রাউন্ড নাইট হেরন,(Black-crowned night heron) বৈজ্ঞানিক নামঃ Nycticorax nycticorax, গোত্রঃ আডিদি।
আরও পড়ুন…
•গো বক
•সবুজ বক
•বেগুনি বক
•খুন্তে বক
•হলদে বক
•রঙিলা বক
•ধূসর বক
•কালিবক
•দেশি কানিবক
•ছোট ধলা বক
•নলঘোঙ্গা
নিশিবকের সাইজ কানিবকের মতোই। তবে একটু মোটাসোঁটা। লম্বায় এরা ৩৬-৩৮ সেন্টিমিটার। গলা, বুক, পেট ধূসর সাদা ও পিঠ গাঢ় সুরমা রংয়ের। মাথার উপর দুই পালকবিশিষ্ট ঝুঁটি। পালক দুটি পেছনে পিঠ অবধি নামিয়ে রাখে। উত্তেজিত হলে মাঝে মধ্যে খাড়া করার চেষ্টা করে। পুরোপুরি খাড়া করতে পারে না। নেতিয়ে পড়ে। আমাদের দেশে মোট ২০ প্রজাতির বক স্থায়ীভাবে বাস করে।
তার মধ্যে শুধু নিশিবকই রাতের আঁধারে শিকারে বের হয়। ওদের শিকারের তালিকায় রয়েছে মাছ, ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় ইত্যাদি। দিনের বেলায় কিছু খায় না এরা। খাদ্য গ্রহণের সময় একাএকা বিচরণ করলেও দিনের বেলায় গাছের উঁচু ডালে দলবল নিয়ে বসে থাকে বা ঘুমিয়ে কাটায়। দলের কাউকে না পেলে ডোবা-নালার গুল্মলতা অথবা কচুরিপানার ভেতর চুপটি মেরে বসে থাকে। রাতের আঁধারটা ওদের জন্য নিরাপদ। কারণ দিনের চেয়ে রাতে চোখে ভালো দেখে।
প্রজনন সময় বর্ষা মৌসুম। বাসা বাঁধে গাছের উঁচু ডালে । ডিম পাড়ে ৩-৪টি। ডিম ফুটতে সময় নেয় ২১দিন। বাচ্চা পরিচর্যা করে স্ত্রী-পুরুষ মিলেই। দেশের মানুষ পাখিবান্ধব হলে এবং শিকারিদের দৌরাত্দ্য বন্ধ হলে এদের সংখ্যা বাড়তে পারে। ঠেকানো যেতে পারে নিশিবকদের হারিয়ে যাওয়া।
লেখকঃ আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।